Monday, 23 September 2024

ফিরে দেখা: জুলাই-আগস্টের সরকার পতন আন্দোলন

জুলাই-আগস্টের আন্দোলন নিয়ে আজ বিভিন্নজন নানা কৃতিত্ব দাবি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই কৃতিত্ব দাবি করা আন্দোলনের প্রকৃত চেতনার সাথে মানানসই নয়। কারণ, সরকার পতনের এই আন্দোলনে কোনো ব্যক্তি বা দলের একক অবদান নেই। এমনকি ছাত্রদেরও এককভাবে এই আন্দোলনের কৃতিত্ব দেওয়া যায় না। আন্দোলনের সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্তে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া এই আন্দোলন কখনই সফল হতো না।



যে নারী রান্না করে রাস্তায় আন্দোলনকারীদের খাওয়াতেন, তিনি কোনো দলের ছিলেন না। যে রিকশাচালক ছাত্রদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বজ্রমুষ্ঠি উঁচিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তিনি কোনো দলের ছিলেন না। যে বয়স্ক বাবা নিজের ছেলের পিছু পিছু রাস্তায় নেমে এসে অন্য অভিভাবকদের রাস্তায় নামার আহ্বান জানাচ্ছিলেন, তিনিও কোনো দলের ছিলেন না। মিরপুর বা যাত্রাবাড়ীতে যে হাজারো জনতা বুক পেতে দিয়েছিল ঘাতকদের বুলেটের সামনে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। যে সাহসী সাংবাদিক বুলেটের ঝড়ের মাঝেও আন্দোলনের দৃশ্য ধারণ করে তা ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন, তারও কোনো দলীয় পরিচয় ছিল না। এমনকি যারা বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে সকলকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছিল, তাদেরও সে দিন কোনো দলীয় পরিচয় ছিল না।


এই আন্দোলন ছিল ছাত্র জনতার। সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ একসঙ্গে রাস্তায় নেমে এসেছিল বলে এই আন্দোলন সফল হয়েছে। এ সত্য সবার জানা। জাতীয় পার্টি, কিছু বাম সংগঠন এবং আওয়ামী মহাজোটের দলগুলো এই আন্দোলনে যোগ দেয়নি, বরং বিরোধিতা করেছিল। তবে জামায়াত, বিএনপি, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদসহ অন্যান্য দলগুলো সক্রিয়ভাবে এতে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল সাধারণ ছাত্র জনতা, তাদের অংশগ্রহণেই এই বিপ্লব সফল হয়েছে।


আন্দোলন চলাকালে আমি আসিফ মাহমুদ এবং নাহিদকে বেশি ফলো করতাম। বাকিদের চিনেছি পাঁচ আগস্টের পর। দেশের নেট সংযোগ বন্ধ থাকায় যারা বিদেশে ছিলেন, যেমন পিনাকী দা, জাওয়াদ নির্ঝর, ইলিয়াস হোসেন, এবং জুলকারনাইন শায়ের—তাদের আইডি ফলো করতাম। তাদের দেয়া তথ্যগুলো থেকে বুঝতাম দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, যদিও পুরো চিত্র পাওয়া যেত না।


আমাদের এবি পার্টির ঢাকা ও সারাদেশের কেউই ঘরে বসে ছিলেন না। প্রতিদিন কর্মসূচি ছিল আন্দোলনের দিনগুলোতে। ব্যারিস্টার ফুয়াদ ভাইয়ের জ্বালাময়ী বক্তৃতা লাখো মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এডভোকেট তাজুল ভাইয়ের নেতৃত্বে আইনজীবী দল প্রতিদিন আদালতে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রদের জামিনের জন্য লড়াই করছিলেন। আমি দেখেছি আলী নাসের খান ভাই রাত জেগে ব্যানার-ফেস্টুন তৈরি করে দিচ্ছিলেন ছাত্রদের জন্য। ছাত্রপক্ষের আহ্বায়ক মুহাম্মদ প্রিন্স আন্দোলনের সম্মুখ যোদ্ধা ছিলেন। এবি পার্টির সদস্য সচিব মঞ্জু ভাইসহ অনেক নেতা-কর্মী মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। মঞ্জু ভাইকে পরে গ্রেপ্তার করা হয়, পাঁচ দিনের জন্য রিমান্ডেও নেয়া হয়েছিল। 


আমার নিজের আইডি থেকে লিখতে পারছিলাম না। তখন আরব আমিরাতে ৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আমাদের আইডিগুলো নজরদারিতে ছিল। আন্দোলনের পক্ষের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকদের তালিকা দেওয়া হয়েছিল দুবাইয়ের পুলিশকে। তারা অনেককেই তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, কাস্টডিতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। আমাদের বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব ইউএইর অনেক সদস্য এসব ফেস করছিলেন, বেশ কিছুদিন পুলিশ কাস্টডিতে থাকতে হয়েছিল একজন সিনিয়র সাংবাদিককে। সেই সময় আমি ফেইক আইডি দিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন গ্রুপে লিখতাম। নিজের আইডি থেকে ইন্টারনাল গ্রুপগুলোতে বিভিন্ন পরামর্শ দিতাম, যেগুলো পরে কপিপেস্ট হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। মাঠেও সেই পরামর্শগুলোর বাস্তবায়ন দেখেছি।


এভাবেই সবাই মিলে, সকলের পরামর্শ, অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় এই আন্দোলন চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করেছে। এখানে কারো একক কৃতিত্বের কোনো সুযোগ নেই। কোনো দল বা ব্যক্তি এককভাবে এই আন্দোলনের সাফল্য দাবি করতে পারে না। বিপ্লব সফল হয়েছে সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই।

No comments:

Post a Comment

Pages (17)1234 Next