Thursday 2 April 2020

যুক্তরাজ্যে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে সর্বপ্রথম চার মুসলিম চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন

যুক্তরাজ্যে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে সর্বপ্রথম চার মুসলিম চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন
মূলঃ আইনা খান, অনুবাদঃ জিয়া চৌধুরী

নিহত চিকিৎসকদের পরিবার এবং রোগীরা এই চার চিকিৎসকের কথা কখনোই ভুলতে পারবেন না, যারা করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে মরণপন লড়াই করছিলেন এবং একসময় নিজেরাই আক্রান্ত হয়ে পড়েন।


 বাম দিক থেকে: আদিল আল তায়ার, আলফা সাআদু, হাবিব জায়েদী এবং আমজাদ আল-হাওরানী।

এই চারজন যুক্তরাজ্যের অত্যন্ত স্বনামধন্য চিকিৎসক ছিলেন যারা যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাস মহামারীর বিরুদ্ধে সম্মুখসারীতে লড়াই করছিলেন এবং এই চারজন চিকিৎসকই করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে সর্বপ্রথম মৃত্যুবরণ করেন।

যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে COVID-19 এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা ডাক্তারদের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে।

 এই চারজন মুসলিম চিকিৎসক আফ্রিকা, এশিয়া ও আরব বংশোদ্ভূত ছিলেন।

 ব্রিটিশ ইসলামিক মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডাঃ সালমান ওয়াকার বলেছেন, এই চিকিৎসকদের অবদান ছিল "অপরিসীম"।

তিনি বলেন "তারা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, অভিজ্ঞ চিকিৎসক এবং রোগীদের নিরলস সেবা প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

 "তারা এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করেছিলের। আমরা সবাইকে অনুরোধ করছি যেন তাদের অসমাপ্ত কাজ হাতে তুলে নেন এবং আর কাউকে যেন মরতে না হয় সেজন্য- stay at home, protect the NHS, save lives."

সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে দেশটিতে এই মহামারীতে চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীদের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে ২৩৫২ জন মারা গেছে এবং ২৯,৪৭৪ জন সংক্রমিত হয়েছ। (রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত)। ডাক্তারদের মৃত্যুর পর যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চিকিৎসকদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছে ( এনএইচএস)।

 এনএইচএস হ'ল যুক্তরাজ্যের ব্ল্যাক অ্যান্ড মাইনারিটি এথনিক (বিএমই) কর্মীদের বৃহত্তম নিয়োগকর্তা যা বিএমই ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রায় ৪০.১ শতাংশ চিকিৎসা কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।

 মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রসচিব প্রীতি প্যাটেল ঘোষণা করেছিলেন যে প্রায় ২৮০০ মেডিকেল কর্মচারীর ভিসা ১ অক্টোবরের আগে শেষ হবে, তাদের ভিসা এক বছরের জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হবে "বিনা মূল্যে"।

 এখানে আমি চারজন চিকিৎসকের ব্যাপারে লিখেছ যাদের মৃত্যুটা আসলেই বেদনাদায়কঃ

 ১) আমজাদ আল-হাওরানী - এমন একজন পিতৃতুল্য ব্যক্তিত্ব যিনি মানুষের জন্য লড়াই করেছিলেন

 আমজাদ আল হাওরানীর জন্ম সুদানে। তিনি ছিলেন ছয় ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। ইংল্যাণ্ডের উত্তরের এক বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কান, নাক এবং গলা বিষয়ে পরামর্শদাতা ছিলেন তিনি।

শারিরীক কোন স্বাস্থ্য সমস্যা না থাকলেও, আল-হাওরানি গত শনিবার ৫৫ বছর বয়সে হাসপাতালেই মারা যান।

 তার কনিষ্ঠ ভাই অামেল তার সহোদরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন- "তিনি অন্যের বোঝা নিজের কাঁধে চাপিয়েছিলেন" এবং তাদের বড় ভাই ও বাবার মৃত্যুর পরে "পিতৃতুল্য ব্যক্তিত্ব" হয়েছিলেন।

 তিনি বলেন, "আমজাদ মানসিক ও শারীরিক ভাবে দৃড় চরিত্রের ছিলেন, তবে বেশ শান্ত ও নম্র থাকতের তিনি ছিলেন। " তাঁর শক্তি ছিল ভালোর জন্য লড়াই করা। তিনি ছিলেন একজন রক্ষাকারী, একজন শিল্ডার, মানুষের জন্য লড়াইকারী, তাঁর ভাইদের পক্ষে লড়াইকারী"।

 মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে আল-হাওরানী তাঁর বৃদ্ধ মায়ের জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন, যিনি নিউমোনিয়া থেকে সুস্থ হয়ে উঠার পরে আবার অসুস্থ ছিলেন। আল-হাওরানী তার নাইট শিফটটি শেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে তাকে দেখতে দীর্ঘ দূরত্বে চলে যান। এই সময়ে, তার হালকা ফ্লুর লক্ষণ ছিল যেটা তিনি অতিরিক্ত কাজ করার কারণে হয়েছিল।

 মঙ্গলবার তাঁর দাফনের সময় কেবলমাত্র পরিবারের সদসরা উপস্থিত ছিলেন। তাকে ব্রিস্টলে কবর দেওয়া হয়।

 সোমবার বার্টনের কুইনস হাসপাতালে আল-হাওরানির সহকর্মীরা তার বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।

 ২) হাবিব জায়েদী - একজন দয়ালু, আন্তরিক ব্যক্তিত্ব। তিনি যে প্রকৃত আত্মত্যাগী সেটা জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন।

 পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত হাবিব জায়েদী ছিলেন একজন জেনারেল প্রাকটিসনার, যিনি প্রায় ৫০ বছর আগে যুক্তরাজ্যে চলে এসে দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের এসেক্সে লে-অন-সি-তে কাজ করছিলেন।

 বুধবার, ৭৬ বছর বয়সে, তিনি COVID -19- এ আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

 তিনি সংক্রমিত হওয়ার পর এক সপ্তাহ আইসোলেশনে ছিলেন এবং অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ২৪ ঘন্টা আইসিইউতে থাকার পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 তাঁর পরিবার এক বিবৃতিতে জানায় এটা তাদের জন্য "হৃদয়বিদারক"।

 ক্রিষ্টিন প্লে ৭৩, জায়েদির প্রাক্তন রোগীদের একজন। যাকে মাত্র তিন সপ্তাহ আগে জায়েদি ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করেছিলেন, তিনি বলেন যে, তিনি "হতবাক এবং শোকাহত"।

 তিনি আল জাজিরাকে বলেন, "ডঃ জায়েদী অত্যন্ত চমৎকার ও শ্রদ্ধাভাজন ডাক্তার ছিলেন এবং সকলের প্রতি তিনি সদয়, যত্নশীল, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং হাসিখুশি আচরণ করতেন। তিনি যে প্রকৃত আত্মত্যাগী সেটা জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন।

 দূরত্বের নিষেধাজ্ঞার মেনে কেবল তার নিকটতম আত্মীয়রা তাঁর জানাজায় অংশ নিয়েছিল। তাঁর স্ত্রীকেও আইসোলেশনে রাখা হয়েছে।

 ৩) আদিল এল তায়ার - একজন বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট, যিনি জরুরী পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকা পালন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন

 আদিল এল তায়ার, ছিলেন এনএইচএস সার্জন, ২৫ মার্চ, ৬৪ বছর বয়সে মারা যান।

 তিনি ছিলেন অঙ্গ প্রতিস্থাপন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট। তিনি ১৯৮২ সালে খারতুম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা বিদ্যায় স্নাতক হন।

 এল তাইয়ার জরুরি বিভাগের স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে ইংল্যান্ডের পশ্চিমে হেরফোর্ড কাউন্টি হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। তার পরিবার বিশ্বাস করে যে তিনি সেখানেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

 তার লক্ষণগুলি প্রকাশ পেলে তাকে আইসোলেশনে রাখা হয়। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছিল।

 বিবিসির সাংবাদিক জিনব বদাভি, তার চাচাত ভাই, বলেছেন: "তিনি সেখানে থাকতে চেয়েছিলেন যেখানে তিনি এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারবেন।

 "ব্যস্ত হাসপাতালের কর্মরত একজন সুস্থ ও দক্ষ ডাক্তার থেকে হাসপাতালের মর্গে শুয়ে থাকতে আদিল এল তায়ার এর মাত্র ১২ দিন সময় লেগেছে।"

 চলতি সপ্তাহে তাঁর জানাজার আয়োজন করা হবে।

সুদানের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ইরফান সিদ্দিক টুইটারে চারজনের প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং "অসাধারণ সাহস" দেখানোর জন্য চিকিৎসকদের ধন্যবাদ জানান।




 ৪) আলফা সা'আদু - একজন প্রবীণ চিকিৎসক, যিনি কেবল ঔষধ সম্পর্কে বলতেন।

 নাইজেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী আলফা সাআদু প্রায় ৪০ বছর ধরে এনএইচএসের সাথে কাজ করছিলেন। করোনা ভাইরাসের সাথে দুই সপ্তাহের লড়াইয়ের পরে গত মঙ্গলবার তিনি ৬৮ বছর বয়সে মারা যান।

 চিকিৎসা পেশা থেকে অবসর গ্রহণের পরেও তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিলেন।

 নাইজেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী, সাআদু ১৯৭৬ সালে লন্ডনে এসে ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতাল মেডিকেল স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পরে জেরিয়াট্রিক ঔষধের পরামর্শদাতা চিকিৎসক হিসাবে তার চিকিৎসা জীবন শুরু করেছিলেন।

 সাদুর ছেলে দানি আল জাজিরাকে বলেছেন: "তিনি খুব আবেগী মানুষ ছিলেন, তিনি লোককে বাঁচানোর বিষয়ে চিন্তা করতেন। তার সাথে ওষুধ সম্পর্কে কথা বলার সাথে সাথেই তাঁর মুখটি আলোকিত হয়ে উঠত। তিনি প্রায় ৪০বছর ধরে বিভিন্ন হাসপাতালে এনএইচএসের হয়ে কাজ করেছিলেন।

 "তিনি চিকিৎসকদের সেমিনারে বক্তৃতা দিতে পছন্দ করতেন। তিনি যুক্তরাজ্য এবং আফ্রিকাতেও তাই করেছিলেন। আমার বাবা অবসর গ্রহণ করেছিলেন এবং হার্টফোর্ডশায়ার ওয়েলউইনের কুইন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাসপাতালে খণ্ডকালীন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ছিলেন এক বিশাল পরিবারের মানুষ এবং আমরা একসাথে সব কিছু করেছি। তিনি দুটি ছেলে এবং একটি স্ত্রী রেখে গেছেন, যিনি নিজেই অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক। "

 নাইজেরিয়ান সেনেটের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বুকোলা সরাকি টুইটারে সাদুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, তিনি "প্রবাসে আমাদের লোকদের জন্য নেতৃত্ব দিয়েছেন"।


মুল লেখার লিংকঃ https://www.aljazeera.com/news/2020/04/muslim-minority-doctors-die-front-line-uk-pandemic-200401082454308.html

No comments:

Post a Comment