করোনাভাইরাস প্যানাডেমিক বিশ্ব ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বদলে দেবে
মুল- হেনরি এ কিসিঞ্জার, অনুবাদ- জিয়া চৌধুরী।
নতুন যুগের প্রারম্ভে সবকিছু নতুনভাবে শুরু করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই তার নাগরিকদের এই রোগ থেকে রক্ষা করতে হবে।
কোভিড -১৯ মহামারীর এই পরাবাস্তব পরিবেশ আমাকে বালজের যুদ্ধের সময় ৮৪ তম পদাতিক বিভাগের একজন তরুন সৈনিক হিসেবে আমার সেই অনুভুতিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
তখন, ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে, সম্ভাব্য বিপদের তোয়াক্কা ছাড়াই, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট না করে, এলোপাথাড়ি ভাবে ক্রমাগত ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হত।
তবে অনেক আগের সেই সময় এবং বর্তমানের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। তখন জাতির স্বার্থ রক্ষায় আমেরিকানদের সুদৃড় সহনশীলতা ছিল।
এখন, এই বিভক্ত দেশে, একটি দক্ষ ও দূরদর্শী সরকার প্রয়োজন, যেটি বিশ্বজুড়ে আসন্ন সকল প্রতিকুলতা দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করবে। সামাজিক সংহতি, পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য জনগণের আস্থা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জাতিসমূহ এই বিশ্বাসের সাথে ঐক্যবদ্ধ এবং বিস্তৃতি লাভ করে যে, তাদের প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্যোগের পূর্বাভাস দিতে পারে, এর প্রভাব সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে। কোভিড -১৯ মহামারী শেষ হওয়ার পর অনেক দেশের এসব প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যর্থতা প্রমাণিত হবে। এটা কতুটুকু বস্তুনিষ্ঠ তা যাচাই করাটা অপ্রাসঙ্গিক। বাস্তবতা হল, করোনাভাইরাস নির্মুলের পরে পৃথিবী আর কখনোই এখনকার মত থাকবেনা। অতীতের ভুলত্রুটি সম্পর্কে তর্ক করা মানে এখন যা করতে হবে সেটাকে আরও কঠিন করে তোলা।
করোনাভাইরাসটি অভূতপূর্ব মাত্রায় অত্যন্ত হিংস্রতা নিয়ে আঘাত করেছে। এটি উল্লেখযোগ্য হারে বিস্তার লাভ করছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি পঞ্চম দিনে দ্বিগুণ হচ্ছে। এই লেখাটি লিখার সময়ও, এটি নিরাময়ের কোনও উপায় নেই। সংক্রমনের তীব্রতা মোকাবেলায় চিকিৎসা সামগ্রীর সরবরাহ অপর্যাপ্ত। নিবিড়-পরিচর্যা ইউনিটগুলিতে সংকুলান হচ্ছেনা। সংক্রমণের মাত্রা চিহ্নিত করার জন্য টেস্টিং কিটের স্বল্পতার কারণে এর প্রসারের গতিকে রোধ করা যাচ্ছেনা। যদিও ১২ থেকে ১৮ মাস পরে এর ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মার্কিন প্রশাসন তাৎক্ষণিক বিপর্যয় এড়াতে একটি দৃড় পদক্ষেপ নিয়েছে। চূড়ান্ত পদক্ষেপটি হল, ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়া থামাতে এবং সংক্রমনের মাত্রা কমিয়ে এনে জনগণের আস্থা বজায় রাখার দায়িত্ব জনগণের উপরেই দিয়েছে। সঙ্কট মোচনে যদিও সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তবুও করোনাভাইরাস সংক্রমন পূর্বের সময়ের মত সমন্বিত উদ্যোগ চালু করতে গিয়ে জরুরি কাজগুলো বন্ধ রাখা কখনই উচিত নয়।
নেতারা এই সঙ্কটটি মূলত জাতীয় ভিত্তিতেই মোকাবেলা করছেন। তবে এই ভাইরাসের সমাজ-বিধ্বংসী ক্ষমতা রাষ্ট্রের সীমানা মানছেনা। যদিও আশা করা যায় মানুষের স্বাস্থ্যের উপর আক্রমণটি সাময়িক হবে। তবে এটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কয়েক প্রজন্ম ধরে বজায় থাকবে। কোনও দেশ, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায়ও এই ভাইরাসকে পুরোপুরিভাবে নির্মূল করতে পারবেনা। এই মুহুর্তের করনীয় চূড়ান্তভাবে নির্ধারন করতে একটি বৈশ্বিক সহযোগী দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মসূচীর সাথে মিলিত হতে হবে। যদি আমরা এটা যৌথভাবে মোকাবিলা না করতে পারি তবে আমরা প্রত্যেকেই সবচেয়ে কঠিন খারাপের মুখোমুখি হব।
মার্শাল প্ল্যান এবং ম্যানহাটন প্রকল্পের রুপরেখা অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিনটি পর্যায়ে একটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করতে বাধ্য। প্রথমত, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে উপায় বের করতে বৈশ্বিক সহনশীলতা তৈরী করতে হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও প্রযুক্তিগত বিস্ময় বিশেষ করে, পোলিও ভ্যাকসিন তৈরী বা স্মল পক্স নির্মুল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যান আমাদের একটি বিপজ্জনক আত্মতৃপ্তিতে প্ররোচিত করেছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং বৃহৎ জনগোষ্ঠী জুড়ে ভ্যাকসিনের জন্য নতুন কৌশল এবং প্রযুক্তির বিকাশ করা দরকার। নগর, রাজ্য এবং অঞ্চলসমূহকে বিজ্ঞানের সীমান্তে স্টকপাইলিং, সমবায় পরিকল্পনা এবং অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদের জনগণকে মহামারী থেকে রক্ষা করার জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিশ্ব অর্থনীতির উপর আঘাত প্রতিরোধে সকলেই সচেষ্ট হতে হবে। বিশ্ব নেতারা ২০০৮ সালের আর্থিক সঙ্কট থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিতে হবে। বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট আরও জটিল: করোনাভাইরাসের কারণে এর গতি অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে আসছে। প্রয়োজনীয় সামাজিক-স্বাস্থ্য ব্যবস্থাগুলি যেমন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং স্কুল ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া, এসব বিষয় অর্থনৈতিক মন্দাকে ত্বরান্বিত করছে। বিশ্বের সবচেয়ে দূর্বল জনগোষ্ঠীকে আসন্ন বিশৃঙ্খলার প্রভাব হতে মুক্ত রাখার উপায় খুঁজে পেতে হবে।
তৃতীয়ত, উদার বিশ্ব ব্যবস্থার নীতিগুলি মেনে চলতে হবে। আধুনিক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে একসময় ধারণা ছিল, জনগণ একটি প্রাচীরযুক্ত শহরে শক্তিশালী শাসক দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে। শাসকরা কখনও হতাশ, কখনও উদার, তবুও জনগণকে বাহ্যিক শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে সর্বদা যথেষ্ট শক্তিশালী হবে। আধুনিক চিন্তাবিদরা এই ধারণাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যুক্তি দিয়েছিলেন যে বৈধ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হ'ল জনগণের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা: সুরক্ষা, শৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক মঙ্গল ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। ব্যক্তি নিজে এই জিনিসগুলি সুরক্ষিত করতে পারে না। মহামারীটি উৎসাহিত করছে সেই ক্মালবৈষম্যমূলক প্রাচীরযুক্ত সুরক্ষিত শহর ব্যবস্থায় ফিরে যেতে, যখন সমৃদ্ধি বিশ্ব বাণিজ্য এবং মানুষের অবাধ চলাচলের উপর নির্ভর করে।
বিশ্বে গণতন্ত্রকে তার উজ্জ্বল ও নির্ভরযোগ্য ভূমিকাকে বজায় রাখতে হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য থেকে সরে আসার চেষ্টা বৈধতা ও সামাজিক চুক্তি নষ্ট করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয়ভাবেই বিভক্ত করতে বাধ্য করবে। তবুও হাজার বছর ধরে চলে আসা বৈধতা ও ক্ষমতার এই বিষয়টি কোভিড -১৯ প্লেগকে কাটিয়ে ওঠার সাথে একসাথে নিষ্পত্তি করা যায় না। ঘরোয়া রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি উভয় ক্ষেত্রেই সংযম দরকার। এক্ষেত্রে কোনটার অগ্রাধিকার প্রাপ্য সেটা দেখতে হবে।
আমরা বালজের যুদ্ধ থেকে শুরু করে বর্তমান বিশ্বের ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধি এবং মানব মর্যাদার বিস্তৃতি পর্যন্ত আলাপ করলাম। এখন, আমরা নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে আছি। নেতাদের নিকট ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ হ'ল ভবিষ্যত গড়াকালীন সংকট মোকাবিলা করা। ব্যর্থ হলে এটি পুরো বিশ্বে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে।
---------------------------------------
মিঃ কিসিঞ্জার নিক্সন এবং ফোর্ড প্রশাসনের স্টেট সেক্রেটারি এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
https://www.henryakissinger.com/articles/the-coronavirus-pandemic-will-forever-alter-the-world-order/
No comments:
Post a Comment