Monday, 13 April 2020

প্লেগ, রাজনীতি এবং দ্বন্দ্ব: বহু শতাব্দী জুড়ে হজ্ব বন্ধের কারণ

মুলঃ মুস্তফা আবু সেনিন, অনুবাদঃ জিয়া চৌধুরী।

সৌদি আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর করোনাভাইরাসের কারণে প্রথমবারের মত মুসলমানদের পবিত্র হজ্ব পালন করতে দেখা যাবেনা। এর আগে অনেকবার নানা কারণে হজ্ব পালন বন্ধ রাখতে হয়েছিল, এবার ২০২০ সালটি হজ্ব বাতিলের সেই তালিকায় যুক্ত হতে চলেছে।

মুসলিমরা পবিত্র কাবা শরীফ তাওয়াফ করছে, ১৩ মার্চ তোলা ছবি। এএফপি।

সৌদি আরব সম্প্রতি এই বছরের পবিত্র হজ্ব বাতিল হতে পারে বলে ঘোষণা দিয়েছে এবং করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় হজ্বযাত্রীদের প্রস্তুতি এবং ভ্রমণ বুকিং স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়েছে।

এবছর প্রায় দুই মিলিয়ন লোক পবিত্র হজ্ব পালন করতে সৌদিআরবের মক্কায় যাওয়ার কথা ছিল, যেটি এই বছর জুলাই মাসে শুরু হওয়ার কথা। তবে দেশটিতে ৪৪৬২ টি করোনাভাইরাস সনাক্তের ঘটনা এবং ৫৯ জন নিহত হওয়ার কারণে হজ্বপালন নিয়ে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে।

 বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত সৌদি আরবও এই মহামারী রোধের জন্য লকডডাউন ও কারফিউ জারী করেছে এবং পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনায় প্রবেশে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। রিয়াদ ইতোমধ্যে ওমরাহ পালন স্থগিত করেছে।


সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ বিষয়ক মন্ত্রী মুহাম্মদ সালিহ বিন তাহের বাতেন একটি সৌদি টিভি চ্যানেলকে বলেন, যে সমস্ত মুসলমানরা জীবনে কমপক্ষে একবার হজ্ব করার প্রত্যাশা করছেন তাদের "চুক্তি সম্পাদনের আগে অপেক্ষা করা উচিত"।

 "আমরা বিশ্বব্যাপী আমাদের মুসলিম ভাইদেরকে বিষয়টি নির্মুল হওয়ার আগ পর্যন্ত চুক্তি না করে অপেক্ষা করতে বলেছি," বাতেন বলেন।

 তিনি আরও বলেন "বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা যেমন বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী নিয়ে কথা বলছি, তেমনি আমরা আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রার্থনা করছি আমাদের রক্ষা করার জন্য। আমদের রাজ্য মুসলমান সহ নাগরিকদের স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক।"

বাতেন বলেন, হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মক্কা সফর স্থগিত করার পরে ট্রাভেল এজেন্সিগুলিতে ওমরাহ ভিসার ফি ফিরিয়ে দিয়েছে।

 যদিও বহু শতাব্দী ধরে কয়েকবার হজ্ব পালন বাতিল করা হয়েছে, কিন্তু ১৯৩২ সালে সৌদি আরবের রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোন বছরেই হজ্বপালন বন্ধ রাখা হয়নি। এমনকি ১৯১৭-১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীতে বিশ্বজুড়ে কয়েক মিলিয়ন লোক মারা যাওয়ার সময়ও বন্ঙ রাখা হয়নি।

 তবে সৌদি আরব যদি ২০২০ এর হজ্ব বাতিল করে দেয়, তবে সেটা ৬২৯ সালে প্রথমবার বাতিল করার পর থেকে প্রায় ৪০ টি ঘটনাবহুল হজ্ব বাতিলের তালিকায় যুক্ত হবে। মিডল ইষ্ট আই এর প্রতিবেদনে ইতিহাসের সবচেয়ে ঘটনাবহুল কয়েকটি হজ্ব বাতিলের ঘটনা তুলো ধরা হল-

 ৮৬৫: আরাফাত পর্বতমালায় গণহত্যাঃ
৮৬৫ সালে বাগদাদে অবস্থিত আব্বাসীয় খিলাফতের সাথে বিরোধের সময়, আল-সাফাক নামে খ্যাত ইসমাইল বিন ইউসুফ পবিত্র আরাফাত পর্বতমালায় আক্রমণ চালিয়ে সেখানে হজ্বযাত্রীদের গণহত্যা চালায়। এ হত্যাকান্ডের ফলে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ পুরো হজ্ব বাতিল করতে বাধ্য হয়।

 ৯৩০: কার্মাতিয়ানদের হামলাঃ
 ৯৩০ সালে, বাহরাইনে অবস্থিত কার্মাতিয়ান হেটেরোডক্স সম্প্রদায়ের প্রধান আবু তাহের আল-জানাবী মক্কা আক্রমণ করে।

ঐতিহাসিক বিবরণে বলা হয়েছে যে কার্মাতিয়ানরা পবিত্র শহরে ৩০,০০০ হজ্বযাত্রীকে হত্যা করে তাদের মৃতদেহ পবিত্র জমজম কূপে ফেলে দেয়। তারা গ্র্যান্ড মসজিদে লুটতরাজ চালায় এবং হাজরে আসওয়াদ চুরি করে বাহরাইন এর একটি দ্বীপে নিয়ে যায়।

হাজরে আসওয়াদ মক্কায় ফিরিয়ে আনার আগে প্রায় দশ বছর হজ্ব পালন স্থগিত করা হয়েছিল।

 কার্মাতিয়ানরা হলেন একটি ইসমাইলি শিয়া সম্প্রদায় যারা সমতাবাদী সমাজে বিশ্বাসী ছিল এবং হজ্বপালনকে একটি পৌত্তলিক অনুষ্ঠান মনে করত।

 ৯৮৩: আব্বাসীয় এবং ফাতেমী খেলাফতের বিরোধঃ
রাজনীতিও হজ্বকে ব্যহত করেছে। ৯৮৩ সালে দুই খলিফা- ইরাক ও সিরিয়ার আব্বাসীয়গণ এবং মিশরের ফাতেমীদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ মক্কায় ভ্রমণকারী মুসলমানদের উপরে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এর প্রভাবে ৯৯১ সাল পর্যন্ত আট বছরের জন্য হজ্ব বন্ধ ছিল।

 ১৮৩১: প্লেগ মহামারীঃ
 শুধু বিরোধ ও গণহত্যার জন্য হজ্ব বাতিল ছিল তা নয়। ১৮৩১ সালে ভারত থেকে উৎপন্ন হওয়া একটি মহামারী মক্কায় আঘাত হানে এবং সেখানে তিন-চতুর্থাংশ হজ্বযাত্রী মৃত্যুবরণ করেন, যারা হজ পালনের জন্য বিপজ্জনক এই বন্ধ্যাভূমিতে কয়েক সপ্তাহ ভ্রমণ করেছিলেন।

 ১৮৩৭-১৮৫৮: ধারাবাহিক মহামারীঃ 
 প্রায় দুই দশকের ব্যবধানে তিনবার হজ বন্ধ রাখা হয়েছিল, এবং হজযাত্রীরা মোট সাত বছর মক্কায় যেতে পারেননি।

 ১৮৩৭ সালে, আরেকটি মহামারী পবিত্র শহরে আঘাত হানে এবং ১৮৪০ সাল পর্যন্ত এটি স্থায়ী ছিল।

এরপরে ১৮৪৬ সালে এক ধরণের কলেরা মক্কা নগরীতে আঘাত হানে। এতে ১৫০০০ জনেরও বেশি লোক মারা যায়। ১৮৫০ সাল পর্যন্ত এটার প্রার্দুভাব বজায় থাকে। ১৮৬৫ ও ১৮৮৩ সালে এটি আবারও দেখা গিয়েছিল।

১৮৫৮ সালে, আরেকটি বৈশ্বিক কলেরা মহামারী মক্কা নগরীতে এসে পৌঁছেছিল, এবং মিশরীয় হজ্বযাত্রীদের মিশরের লোহিত সাগরের তীরে ম্যাসে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল। সেখানে তাদের কোয়ারেন্টাইন্ড করা হয়।

মুলঃ https://www.middleeasteye.net/news/coronavirus-saudi-arabia-muslims-hajj-cancel-pilgrim

No comments:

Post a Comment