Thursday 3 March 2011

সময় থাকতে ফেসবুক নিয়ে ধান্দাবাজি বন্ধ করেন, গ্রামীণফোন

 লেখক: মেহদী হাসান খান
সুত্র: http://www.sachalayatan.com/omicronlab/37843

১) গত মঙ্গলবার রাতে গ্রামীণফোনের মার্কেটিং শাখা কমিউনিকেশন ডিভিশন থেকে রিফাত এবং আমি জরুরী ফোন পাই। গ্রামীণফোন ফেসবুক থেকে একটা এন্ডোর্সমেন্ট চেয়েছিল, সেটা পেতে যাচ্ছে এবং তার প্রেক্ষিতে ফেসবুক বাংলা লোকালাইজেশনের কাজ বড় আকারে করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা কী জানতে চাইলে বলা হয়, এখানে অভ্র ব্যবহার করলে আমাদের আপত্তি বা কোন ধরনের দাবী আছে কিনা সে নিয়ে ছোট একটা মিটিং-এ বসতে হবে। উদ্যোগটা শুনে ভালো লেগেছিল। তাই “জাতীয় সঙ্গীত ভিন্নভাবে গাওয়া” অথবা “দুনিয়া কাঁপানো ত্রিশ মিনিট” এর মতো নষ্টামির বাইরে একটা সত্যিকার কাজের কাজ হতে যাচ্ছে ভেবে মুহূর্তের নোটিশে ছুটি জোগাড় করে ঢাকা চলে এসেছিলাম।
যাই হোক, মিটিং শেষ করে করে বুঝলাম, কর্পোরেট রাজ্যে আধিপত্য থাকলেও স্বেচ্ছাশ্রম, ক্রাউডসোর্স অথবা ওপেনসোর্স দুনিয়া সম্পর্কে জিপির এই ক্যাম্পেইন সংশ্লিষ্ট লোকজন খুব একটা ওয়াকিবহাল না। অভ্র কমার্শিয়াল কাজে ব্যবহার করলেও কেন এবং কিভাবে ফ্রি হয় এটা বুঝাতেই আমাদের কালোঘাম ছুটে গিয়েছে। মোজিলা পাবলিক লাইসেন্সের রেফারেন্স দাওয়ার পরেও তাদের অনুরোধে “অভ্র ব্যবহার করলে আমাদের আপত্তি নাই” লিখে মেইল করে দিতে হয়েছে। এবং প্রেস রিলিজটা বের হবার পর বুঝলাম, ক্রাউডসোর্সিং বা বাংলায় অনুবাদ করা দূরে থাক, বাংলা লিখতে কী লাগে সেটা নিয়ে পর্যন্ত তাদের ধারণা নাই। একই সাথে নাই ইতিমধ্যে যাঁরা স্ব-উদ্যোগে ফেসবুকের বাংলা করার কাজটা অর্ধেকের বেশি এগিয়ে নিয়ে এসেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার মানসিকতা। তাদের উদ্যোগটা ভালো হতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য এবং প্রচারভঙ্গী নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন তোলা যায়। হাসিব ভাইয়ের পোস্টে বিস্তারিত বলা হয়েছে, আগ্রহীরা এখান থেকে পড়ে নিন: ফেইসবুক অনুবাদের কৃতিত্ব হাইজ্যাকে গ্রামীণ ফোনের চেষ্টা
আমাকে বলা হয়েছিল এই ক্যাম্পেইন কয়েকটা পর্যায়ে করা হবে। তার অর্থ এখনো সংশোধনের সুযোগ আছে। সেজন্যেই এই লেখা।
২) কোনরকম কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান অথবা “বাংলা ভাষার আপন কাগুদের” সাহায্য ছাড়া ফেসবুকের অর্ধেকের বেশি বাংলা লোকালাইজেশনের কাজ শেষ হয়েছে, বাকিটাও হবে। যেমনভাবে হয়েছে উইকিমিডিয়া, ফায়ারফক্স, অপেরা, ওয়ার্ডপ্রেস, পানবিবি, পিএইচপিবিবি, নোম ইত্যাদি অসংখ্য সফটওয়্যারের লোকালাইজেশনের কাজ। আমি বাংলা কম্পিউটিং সংক্রান্ত খবরের খোঁজ রাখার চেষ্টা করি সবসময়, তারপরও যেসমস্ত স্বেচ্ছাসেবক নিজের ব্যক্তিগত সময় এবং শ্রম দিয়ে এসব কাজ করেছেন তাঁদের বেশিরভাগকেই চিনি না। কারণটা খুব সহজ, আত্মপ্রচার নিয়ে তাঁরা লালায়িত নন। তাঁরা যেটা করছেন বা করছেন সেটা নিজের ভাষার জন্য ভালোবাসা থেকে আসা দায়িত্ববোধ থেকেই। তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিতে শিখুন। গ্রামীণফোন যেখানে এখন পর্যন্ত বুঝেও উঠতে পারে নাই লোকালাইজেশন প্রজেক্ট কিভাবে চলে, সেখানে “...গ্রামীণফোন ও ফেসবুক যৌথভাবে এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে আপনি চাইলেই হতে পারেন এর সফল অনুবাদক...” এ ধরনের নির্লজ্জ মিথ্যাচার বন্ধ করুন। ফেসবুকে অনুবাদক হতে হলে কোন ছাতা ফোনেরও দরকার নাই, যদু-মধু-কদু সবাই হতে পারে। আপনারা কী খান জানিনা, কিন্তু পাবলিক “যা গিলাবেন তাই খাবে” এটা ভাবলে এখনও বোকার স্বর্গে আছেন।
৩) আপনাদের দেশপ্রেমের ওরস্যালাইন মেশানো ফর্মুলার টিভি কমার্শিয়াল আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে, খুব স্থূলভাবে তাকিয়েও সেগুলোর ভিতরের কংকালটা আমরা এখন দেখে ফেলি। তারপরও ফেব্রুয়ারি আসলেই আপনাদের মধ্যে ভাষার জন্য ভালোবাসা দেখানোর আলগা প্রতিযোগিতাটা থামে না। লোকালাইজেশনের কাজটা যদি সত্যিই করার ইচ্ছা থাকে তাহলে রকম একটা/দুইটা ফেব্রুয়ারির হুজুগে সেটা কাজ শেষ করে ফেলবেন ভাবাটা ভুল হবে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। ফেসবুকের উন্নয়নের সাথে সাথে এর স্ট্রিং টেবিলে নতুন নতুন সংযোজন ঘটবে, সেগুলার অনুবাদও চালিয়ে যেতে হবে। দৌড়ে এসে পানিতে ঝাপ দেয়ার আগে সেটা কত গভীর দেখে নেয়া ভালো।
৪) লোকালাইজেশন সংবেদনশীল কাজ। পুরষ্কার কপালে জুটে না, কিন্তু এদিক ওদিক হলে তিরস্কার একটাও মাটিতে পড়ে না। এর আগে মাইক্রোসফটের কল্যাণে “মাইক্রোসফট উইন্ডোজ এখন অবসর নিচ্ছে” (Microsoft Windows is now shutting down) অথবা গুগলের "খোঁজনদণ্ড" (Search bar), "ঠিকানাদণ্ড" (Address bar)- এ ধরনের হাস্যকর অনুবাদ আমরা দেখেছি। আপনাদের প্রাথমিক পরিকল্পনায় বাংলা একাডেমীকে যুক্ত করার কথা ছিল বলে জানিয়েছিলেন আমাদের, প্রেস রিলিজে সেটা আর দেখা যায়নি। সম্ভব হলে কিছু যোগ্য লোক খুঁজে নিয়ে কাজে বসান। আর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার আগে নিজেদের জিপিআইটি বিভাগের কাউকে হলেও দেখিয়ে নিন। শুধুমাত্র একটা ফন্ট থাকলেই অনুবাদ করা যায় এটা কোথায় পেয়েছেন?
৫) প্রথমে ভেবেছিলাম গ্রামীণফোনের ত্রাণ ছাড়াই যে ৫০০ জন মানুষ ইতিমধ্যে ফেসবুক লোকালাইজেশনের কাজে অংশ নিয়েছে এবং কাজটা প্রায় শেষ করে এনেছেন তাঁদের পরে আপনাদের লাইনে দাঁড়াতে বলাটা যুক্তিযুক্ত হবে। কিন্তু আপনাদের তো আসলে সেটুকু অবদানও নাই। আপনাদের খবরের কাগজে কেনা জমি আছে, সেই যোগ্যতায় নিজেদের প্রচারকের ভূমিকাতে রাখলেই ভালো করবেন। যদি আদৌ কিছু করতে চান, যারা এখনও জানে না ফেসবুক ইতিমধ্যেই বাংলা আছে সেটা তাদের জানান, যারা বাকি কাজটুকুতে অংশ নিতে চান তাদের পথটা দেখিয়ে দিন। এবং সেইসাথে এক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা যে এই জানানো পর্যন্তই সেটা বলার সৎ সাহস দেখালে ভালো করবেন। বিজ্ঞাপনে টেলিনরের লোগোর পাশে ফেসবুকের লোগো বসানোর অনুমতি পাওয়া আপনাদের জন্য ভীষণ উল্লাসের কারণ হতে পারে, উই ডোন্ট গিভ আ শিট।

No comments:

Post a Comment