Tuesday, 3 January 2012

জেগে ওঠো মানুষ, বেঁচে উঠুক তিতাস


মাথার উপর বিস্তীর্ণ নীল আকাশ, চোখ ধাঁধানো রোদ নতুন পথ ধরে হেঁটে আসছে একটি কিশোর। এখনো পুরোপুরি কিশোর বলা যায়না তাকে, সবে ক্লাস সিক্সে উঠেছে। ক্লাস রোল ৫২, একটু অস্বস্তির সাথেই বলেছিল সে। স্থানীয় কেজি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে রোল ১ নিয়েই বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করেছিল, রেজাল্ট বের হলে আসল রোল জানা যাবে সেটা মনে করিয়ে দিতে ভুল করল না। নতুন বইয়ের ঘ্রাণের জন্য আঁকুপাঁকু করছে মন। বড় হয়ে ক্রিকেটার হবে এটাই স্বপ্ন, নামকরা অলরাউন্ডার। ধানকাটার মৌসুম শেষে জমিতেই পিচ বানিয়ে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট, নদীতে সাঁতার আর মাছ ধরা এই নিয়ে তার জীবন। এই কিশোর এখনো জানেনা তার জীবনের প্রধান তিনটি স্বপ্ন আর আনন্দের মধ্যে দুটি, এখনি হুমকির সম্মুক্ষীণ। অলরাউন্ডার হবার স্বপ্নকে সে বয়ে নিয়ে যেতে পারবে কিনা সেটিও অনিশ্চিত।

পথের মাঝে স্কুলফেরা কিশোর

তিতাস নামক প্রাণবন্ত এক তরুণী নদীর কাছে যখন আমরা পৌছলাম তখন শুক্রবারের জুম্মার নামায শুরু হতে আর খুব বেশি সময় বাকী নেই। শীতকাল অনুযায়ী বেমানান খটখটে রোদ। ব্লগারদের জনা পাচেকের আরেকটি দল সুলতানপুর পার করছেন। এখানে চলে আসতে খুব বেশি দেরী হবে না। যে রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ীটি এগিয়ে চলেছিল তাতে যুগ্ম ব্রীজ পার হলেই আখাউড়া পৌরসভা শুরু। স্থানীয়ভাবে এই ব্রীজকে কড্ডা ব্রীজ হিসেবেই ডাকা হয়।

আখাউড়া থেকে ব্রাম্ননবাড়ীয়ার পথ

খুব কাছেই দেখা গেল বিমান নামছে। প্রথমে বিস্মিত হলেও পরক্ষণেই বোঝা গেল বাংলাদেশ-ভারতীয় সীমান্তের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা। সীমান্তের ওপাড়েই আগরতলা। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি নাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, জাতীয় নেতা এইসব ঘটনার কথা মনের ভেতর উঁকি দিয়ে গেল। সাথের বন্ধুরা সীমান্ত দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল, আর তখনি হঠাৎ করেই মনের ভেতর দাবানলের মত জ্বলে উঠল একটি ছবি। যে ছবিতে দেখা যায় কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলন্ত ফেলানির লাশ। বিএসএফ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে সেই লাশ কোরবানীর পশুর মত।

কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলছে ফেলানি

তিতাসের খুন হবার খবর আমরা পাই এই ব্লগেই, দিনমজুরের পোষ্টের সূত্রে।(খবরটি প্রথম জানিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন০৫ )। সেই খবর আমাদের কষ্ট দেয়, বিদ্রোহী করে। কিন্তু লাশের গল্প শোনা আর লাশ ছুঁয়ে আসা এক কথা নয়। তাই ব্লগাররা নিজেদের উদ্যোগে নিজেরাই আয়োজন করে রওনা দেন তিতাসের লাশ দেখার উদ্দেশ্যে। কৌশিক, সবাক, হাসান বিপুল, ইশতিয়াক করিম, তারেক আজিজ এই পাঁচের ব্লগারের দল পৌছান একসাথে। আমি ও আমার বন্ধুরা অলোক, রমিন, রেদোয়ান পৌছাই তাদের একটু আগে। ব্রাম্মনবাড়ীয়া ২৪ নামে একটা নিউজ এজেন্সীর কর্তাব্যক্তিরা আমাদের নানাভাবে সাহায্য করেন।

তিতাসের বুক চিড়ে ট্রানজিট

আমরা দেখি নদীর বুক চিড়ে রাস্তা বানানো হয়েছে। ট্রানজিটের রাস্তা। আমাদের নতজানুতার পথ। এই পথ দেখে আমাদের কষ্ট হয়, ঘৃণা হয়, অবিশ্বাস গাঢ় হয় সরকারের বিবেচনা বোধ আর সদিচ্ছার প্রতি। সন্দেহ দৃঢ় হয় সরকারের মেরুদন্ডহীনতা আর দুর্নীতিতে। ঠিক যেভাবে প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিকের পায়ের উপর দিয়ে নির্মম চলে যায় যন্ত্রযান, যেভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় তার পা শরীর থেকে, ঠিক সেভাবে তিতাসের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে তার প্রবাহমানতাকে।


তবুও এই শীতকালেও বাঁচার আকুতিতে প্রাণোচ্ছল তিতাস

ছোটবেলায় পড়েছিলাম নদীমাতৃক দেশ এই বাংলাদেশ। সেটা কি এরপর পাঠ্যপুস্তকেই রয়ে যাবে? কি দেখবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম! বিশ্বের বৃহত্তম এই ব-দ্বীপে শিরা উপশিরার মত বয়ে চলে নদী-নালা-খাল। একটি নদীর উপর নির্ভর করে লাখলাখ মানুষ। বেঁচে থাকে চারপাশের প্রকৃতি-বাস্তুসংস্থান। ফলে একটি নদী কেবল বিশেষ একটি অঞ্চলের সম্পত্তি নয় সেটি সমগ্র দেশের, দেশের মানুষের সম্পদ। নদীর প্রবাহমানতায় একক এক্তিয়ার নেই কারোই। তাই যখন তখন যেখানে সেখানে বাঁধ দেয়া যায়না। উজান ভাটির মানুষের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। এই সম্পদ কারো একার নয়, এই সম্পদ সমগ্র পৃথিবীর। সারা পৃথিবী ব্যাপী যখন পরিবেশ রক্ষা প্রধানতম বিষয় তখন ক্ষুদ্র স্বার্থপর স্বার্থে সেখানে বাধ সেধেছে নব্য বা পুরাতন শিল্পভিত্তিক রাষ্ট্র। ভারত তাদের অন্যতম।


নদী হত্যা হলে মাছের ব্রিডিং কোথায় হবে?

পরিবেশ বিনষ্টকারী “উন্নয়ন” যে কেবল নামেরই উন্নয়ন তার প্রমাণ হিসেবে এখনো কয়লার মত জ্বলজ্বল করছে লেসোথো, চিলি, উগান্ডা, পাপুয়া নিউগিনি আরো কতশত দেশ। ফলে তিতাসের বুকে রাস্তা বানানো সেই একই হত্যা-তালিকায় আর একটি নামমাত্র। আর এতে আক্রান্ত হবেন লাখো লাখো মানুষ।

স্থানীয় মানুষজনদের সাথে ইন্টারভিউ করে জানা গেল মাত্র ছ-মাস আগে এই রাস্তা তৈরি হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের সাথে কোন ধরণের সংলাপ বা তাদের মতামতের অন্তর্ভূক্তির কোন সুযোগই ঘটেনি। আখাউড়ার ব্লগার আলী মাহমেদ শুভ জানালেন ট্রানজিট শুরু হবার সাথেই এলাকার জমির দাম বেড়ে গেছে বহুগুন। অনেকেই জমির দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে আশাবাদী। কেননা তারা মনে করেন তাহলে স্থানীয় মানুষজনের অর্থনীতিতে এটা একটা “বুম” হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক লাভ হবে কাদের? ক্ষেতিজমির মূল মালিকদের নাকি মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের? নাকি স্থানীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিটদের? এই ধানি জমি বিক্রী হবে কাদের কাছে? শিল্পপতি ইট ভাঁটার মালিকদের কাছে? তারা কি বানাবেন? কলকারখানা? কিসের বিনিময়ে? ধানের জমি, সেচের নদী, মাছের নদীর বিনিময়ে? তাহলে এই নদীর সাথে জড়িত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষজনের জীবনের কি হবে?

বর্ষায় ভ’রে ওঠে এই জমিগুলো। নদী হত্যা হলে চাষবাষের কি হবে?

এই কৃষকের কি হবে? কালো পিচে কি আর ফসল ফলানো যায়?

এই শ্রমিকের কি হবে? কিংবা জেলের? কিংবা ফসলের?

এই ধরণের প্রশ্নগুলো সাধারণত এড়িয়ে যেতে চান আমলা,মন্ত্রী,এমপিরা। এলাকার উন্নয়নের নামে তারা বিসর্জন দেন শতশত মানুষের ন্যুনতম বেঁচে থাকার অধিকার। ব্রাম্মণবাড়ীয়া থেকে আখাউড়া যাবার পথে চোখে পড়ল সদ্য তৈরি হওয়া নতুন পথ। এতটাই আঁকাবাঁকা যে আমাদের গাড়ী চালিয়ে যেতে বেশ কষ্ট হল। যদি এমন বলা হয় “বন্ধু দেশের”???!!! এত বড় ভারী ভারী লরি নেবার জন্য তিতাসের বুক চিড়ে পথ বানানো হয়েছে কেননা বিকল্প ব্রীজের এমন ভার বহনের ক্ষমতা নেই। তাহলে আমি বলব আসলে সমগ্র বাংলাদেশেরই এই ভারতীয় ট্রানজিট বহনের ক্ষমতা নেই। কেননা পুরো রাস্তাকে যেভাবে পরিমার্জন করা হয়েছে টাকা খরচ করা হয়েছে, সেই ধৈর্য্য আর অর্থব্যায় ব্রীজের পুন:গঠনে দেয়া হল না কেন? কিসের এত তাড়া কিসের ভয়ে এত হুটোপুটি করে ট্রানজিট ট্রানজিট করে মাতম করতে হবে?


ট্রানজিটের ভারতীয় বন্ধুত্বের ভার বহনের ক্ষমতা কি আমাদের আছে?


কতদূরে উন্নয়ন?


মালামাল বহনের অন্য কোন রাস্তা ছিলনা? কেন ট্রানজিটের এত তাড়াহুড়ো?

এই হল দেশের উন্নয়নের অবস্থা
যাবার পথেই চোখে পড়েছিল, দিন মজুরের পোষ্টে যেই সংস্কারহীন অযত্নে লালিত ব্রীজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটারই রেলিং ভেঙ্গে উল্টে পড়ে থেতলে গেছে ট্রাক। ঠিক তেমনি হবে এই দেশের যদিনা নিজের ঘরের পথ ঘাট উন্নয়নে মনোনিবেশ না করা হয়। যদি নির্দ্বিধায় গলা টিপে মেরে ফেলি নিজের সম্পদকে। অন্যরাষ্ট্র আর নিজের দেশের কতিপয় দালালের পকেট ভারী হওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না।

আর এই তার ফলাফল
ধানি জমির অনি:শেষ বিলুপ্তি, একের পর এক নদীকে হত্যা করা, কৃষকের কাছ থেকে তার জীবন কেড়ে নেয়া এর সবই ফিরে আসছে বুমেরাং হিসেবে। জ্বালানী আর তেলের মূল্য যেমন অবিশ্বাস্য উর্দ্ধগতির তা পরাস্ত করছে মানুষের ন্যুনতম বেঁচে থাকার চেষ্টাকে। এদেশের ০.১% মানুষ নাহয় ৩০০০টাকা দিয়ে তেল আর ২০০০টাকার চাল খেতে কিনে খেতে পারে কিন্তু বাকীদের বেঁচে থাকাই যে এক যন্ত্রণা। সেই ০.১% মানুষ নাহয় উড়াল দিয়ে উড়ে যেতে পারে ইউরোপ আমেরিকা আর মরিশাসে। কিন্তু বাকী আমাদের থাকতে হবে এই দেশে। কেননা আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ দেখি এই দেশেই, এই রাষ্ট্রেই।

এই সাধারণ মানুষের হাতই টেনে তোলে রাস্ট্রকে বারবার আর রাস্ট্র তার গলাতেই শেকল পড়ায়

স্থানীয় অনেক মানুষজন চাষের জমি তো হারাচ্ছেনই। হারাচ্ছেন সেচের পানিও। আখাউড়া থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত বাঁধ আর কালভার্ট বানিয়ে কত বিস্তীর্ণ একটা অঞ্চলের মানুষজন আক্রান্ত হয়েছেন সে কথা কি ভেবে দেখেছেন আমাদের (অপ-)নীতি নির্ধারকরা?
সময় এসেছে পরিবর্তনের, শহুরে ব্লগিং করা মানুষজনেরও দু-বেলা ঠিকটাক ভাত আর স্বস্তির জীবনের জন্য রক্ষা করতে হবে নামতে হবে দেশের সম্পদকে। প্রতিরোধ করতে হবে সব অন্যায় সিদ্ধান্ত আর নতজানু নীতির।

ব্লগারদের সাথে আলাপে অনেকেই শংকা প্রকাশ করেছিলেন যে স্থানীয় রাজনীতি আর দারিদ্রের কারণে হয়ত অনেককেই সংগঠিত করা সম্ভব হবে না। হয়ত তাদের আশংকা অনেকটা সত্যও। কিন্তু এও সত্য এই মুহুর্তে প্রতিবাদ প্রতিরোধ ছাড়া আর কোন পথ নেই। ব্লগাররা কাজ করতে পারেন স্থানীয় অপনিয়ন লিডার হিসেবে। কেবল রাজধানী-কেন্দ্রীক আন্দোলনের বদলে আমরা এমনও দেখতে পারি যে ব্রাম্মণবাড়ীয়া, আশুগঞ্জের ব্লগাররা প্রতিবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসনকে। অবহিত করেছেন স্থানীয় মানুষদের। সংগঠিত করেছেন। এটা আমাদের করতেই হবে, কেননা শেষমেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবার জায়গায় রয়েছি সেই ৯৯.৯%।

সেই কিশোর ছুঁইছুঁই মুখটার কথা ভুলতে পারিনা কিছুতেই। দু:স্বপ্ন দেখি “বন্ধু” দেশের ট্রানজিট লরিতে পিষ্ট হয়ে থেতলে গেছে তার সমস্ত দেহ। খুব কাছের তিতাসের মত সেও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে আর নিচ্ছে রক্তাক্ত শেষ নি:শ্বাস। আর ধূসর হয়ে আসছে তার নদীতে সাঁতার, মাছ, ক্রিকেট...।


এই কিশোরটিকে বাঁচাতে হবে, নিহত হওয়া থেকে, বিষণ্ন হয়ে স্বপ্নহীন হওয়া থেকে। তিতাসকে বাঁচানো সম্ভব। বাঁচানো সম্ভব এই দেশটাকে। দূর কর, প্রতিরোধ কর ট্রানজিট আর টিপাইমুখের কালো ছায়া।

ট্রানজিটের মালামাল পরিবহণের নামে তিতাস নদী খুন হতে পারে না, আমরা তিতাস নদী বাঁচাবই

No comments:

Post a Comment