Monday, 24 June 2013

চেনা অচেনা

:দোস্ত।সত্যিই চলে যাবি?
:হ্যাঁ রে।কিছু করার নেই।বাবা বলে দিয়েছে,যাওয়া ছাড়া কোন গতি নেই।
:কেন যাবি?এখানে সবার অধিকার সমান।
:তুই মানছিস।ওরা তো মানছে না!
:পিসেমসাই ফিরবেন?
:বলেছেন তো আমাদের বর্ডারটা পার করে দিয়েই তিনি আর জ্যাঠা ট্রেনিং এ যাবেন।তারপর যুদ্ধে।
:গ্রামের বাকী হিন্দুরা তো এখনো কেউই যুদ্ধে যায় নি।পিসেমসাইয়ের যদি কিছু হয়?
:ধুরো পাগল।যুদ্ধে এতটুকু তো থাকবেই।কিন্তু দেখিস দেশ স্বাধীন হবে আর হলেই দৌড়ে ফিরে আসব আমরা।
:কিন্তু শুনেছি ঢাকায় নাকি সব উড়িয়ে দিয়েছে।আমাদের গ্রামটাও যদি উড়িয়ে দেয়।
:দিলে দেবে।দেশটাতো আমাদের।কোথাও না কোথাও ঠিকই জায়গা হয়ে যাবে।রাজাকারগুলো বড্ড ঝামেলা করছে।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে হবে রে।
:ওখানে যেতে কতদিন লাগবে?
:এমনিতে তো সময় লাগে রাস্তা চিনে চিনে যেতে।কিন্তু বাবার মুক্তিদের সাথে জানা পরিচয় আছে।তাড়াতাড়িই পৌছে দেবে।
:তুই মুক্তি দেখেছিস?
:হুম।অনেক।কেন তুই দেখিস নি?
:না তো।
:কেন?শফি ভাই,রাজু ভাই,আযাদ ভাই ওরা সব্বাই মুক্তি।
:কি বলছিস?
:সত্যি।
:আচ্ছা।তুই যুদ্ধে যাবি না?বাবা তো নিজেই খোলাসা করে কিছু বলছে না যাবে কি যাবে না।পিসেমসাই তো যাচ্ছেনই।
:জানি না রে।যেতে তো ইচ্ছে হয়।দেখি।বাবা যেতে না দিলে পালিয়ে যাব।
:সত্যি?তাহলে আমিও পালাব।আমাদের আবার দেখা হবে।
:হয়তো।
:আচ্ছা যদি আমাদের আর দেখা হবে না?
:হবে হবে।ঠিক হবে।এখন না হোক।বড় হই তোকে ঠিক খুঁজে বের করব।
:চিনবি কি করে?আমি বড় হলে তো স্টাইল করে দাড়ি রাখব।
:যত যাই করিস।ঠিক চিনব তোকে।

:সত্যি?
:সত্যি।কেন তুই চিনবি না?
:চিনব।তবুও ভয় হয়।যদি না চিনি?
:তাহলে শোন।মনে আছে গত গ্রীষ্মে জমিদার বাড়ি থেকে আম চুরি করে দাবড়ানি খেলাম।পালাতে গিয়ে ডালে লেগে আমার পিঠ পুরো কেটে গেল?
:হ্যাঁ।মনে থাকবে না আবার।পিঠ দিয়ে কি রক্ত।তাও পালাচ্ছিলি।কত পাতা বেটে লাগিয়ে দিয়েছি।চার মাইল হেটে তোর জন্য শিকড় আনলাম।তারপরেই তো সারল।
:হ্যাঁ।দেখ এখনো ক্ষত কত গভীর।
:ও মা।তাইতো।
:মনে হয় না এই দাগ আর যাবে।এটা দেখে চিনিস।
তুই বুঝি সব সময় শার্ট খুলে বসে থাকবি?
:বাজে বকিস না তো।দেখবি ঠিকই তুই দেখে ফেলেছিস কোন ভাবে।আচ্ছা তুই বিয়ে করবি?
:নাহ।কি যে বলিস।আমি কোনদিন বিয়েই করব না।তুই?
:হুম করব।
:কাকে?
:তা তো জানি না।তবে বিয়ে করে ছেলে হবে যখন তখন ছেলের নাম রাখব রাহাত।
:সত্যি?কিন্তু মুসলমান নাম রাখবি?কোন দেবী যদি শাপ দেয়?
:ডাক নাম রাখলে মনে হয় শাপ দেবে না।
:ও।হা হা হা।খুব মজা হবে।ইস আমরা যদি একসাথে থাকতে পারতাম।
:থাকব থাকব।অপেক্ষা কর।ঠিক থাকব।
:তোরা কাল কখন যাবি?
:ভোরে।
:দেখা করিস কিন্তু।
:কি যে বলিস।দেখা না করে আবার যাব নাকি?

সেদিন দেখা করে নি রবি।সুযোগই পায় নি।রাজাকারগুলো কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে গিয়েছিল।তাই সন্ধ্যাতেই পালিয়েছিল ওরা।এসব কথা মনে করে আনমনে চোখের পানি এসে গেল রাহাতের।তোরো বছরের দুটো বালকের এই সামান্য কথোপোকথনের দুঃখ সুখ বয়ে বেড়ায়।

রাহাত এখন একটা স্টেশনে বসে আছে।সেই গ্রামটাতে যাবে যেখানে রাহাতের শৈশব কেটেছে।রাহাত ঠিকই পালিয়েছিল বাবার হাত ধরে।এক রাতে পাকিস্তানীরা এসে পুরো গ্রামে খুন শুরু করে দিয়েছিল।পালিয়েছিল ওরা।মা সেদিন বাঁচতে পারে নি।কার পায়ের নীচে যে পড়ে হারিয়ে গেল টেরও পায় নি।রাহাত ছিল বাবার কাছে।মাকে আর দেখতে পারে নি বাবা।পরে এসে লাশ পেয়েছিল মায়ের।বাবার হাত ধরে যুদ্ধে গিয়েছিল রাহাত।ছোটখাট অনেক কাজ করেছে রাহাত।খবর পৌছে দেয়া,গুলি পৌছে দেয়া।ছোট বলে সহজেই কাজ করতে পেরেছে।মায়ের জন্য খারাপ লাগত।রবির কথাও খুব করে মনে করত।কিন্তু সব ভুলে কাজ করেছে।নিজের চোখে দেখেছে পাকিস্তানিদের অত্যাচার।কয়েকদিনেই অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল যেন।ব্যাক্তিগত দুঃখ ভুলে দেশটাকেই আগে রেখেছিল।

দেশ স্বাধীন হল।বাবা আর রাহাত গ্রামে আর ফিরল না।বাবা ভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেলেন।রাহাতও পড়াশুনা করা শুরু করল।প্রতিষ্ঠিত হল।কিন্তু রবির কথা কখনো ভোলে নি রাহাত।তাই সময় পেলেই গ্রামে যায়।বলা যায় না রবি হয়তো রাহাতের খোঁজে কখনো এসেছিল।ঠিকানা দিয়ে গেছে।

রাহাত বিয়ে করেছে।ছেলেটা বাবার সাথে গ্রামে আসতে চায়।রাহাত কখনো আনে না।বলা যায় না রবি এসে ছেলেকে দেখে যদি টিটকারী মারে!খুব তো বলেছিলি বিয়ে করবি না।

অজান্তেই হেসে ওঠে রাহাত।বাইরে চোখ চলে যায়।আকাশ কালো মেঘে ঢাকা।বৃষ্টি শুরু হল।কত যে বৃষ্টিতে ভিজেছে রবির সাথে।মা গরম চা বানিয়ে রাখত।বৃষ্টিতে ভিজে এসেই রবি বলত চাচি চা চাই।

রাহাত গিয়ে জানালার পাশে দাড়াল।ট্রেন আসতে দেরী আছে।বাইরে কেউ নেই।শুধু একটা পরিবার।স্বামী স্ত্রী আর ছেলে।বাবার হাত ধরে এদিকেই আসছে ওরা।ভিজে চুপচুপে অবস্থা।হিন্দু পরিবার।মহিলার হাতে শাখা।এসেই ঢুকে পড়ল।রাহাতের মন খারাপ লাগছে।ছেলেটা বৃষ্টি খুব ভালবাসে।সাথে করে আনলে একসাথে ভিজত।
রাহাত।বাবা এদিকে এসো।ভিজে গেছ বাবা।
চমকে ওঠে রাহাত।পেছনে তাকিয়ে দেখে ঐ মহিলাটা তার ছেলেকে ডাকছে।লোকটার মুখের দিকে তাকাল।কই রবির সাথে মিলছে না।বলিষ্ঠ শরীর,লম্বা,চোখে চশমা,ফর্সা,মুখে খোঁচা দাড়ি।কই রবির সাথে মিলছে না।বুক দুরুদুরু কাঁপছে রাহাতের।তাকিয়ে আছে পরিবারটির দিকে।মা টা আঁচল দিয়ে ছেলের মাথা মুছে দিল।শার্টটা খুলে চিপে দিল।
এই তুমিও শার্ট খুলে চিপে নাও।ঠান্ডা লেগে যাবে।
লোকটা রাহাতের সোজাসুজি দাঁড়িয়ে।শার্ট খুলছে লোকটা।লোকটার চশমাটা ভিজে ঝাপসা হয়ে গেছে।চোখ দেখতে পারছে না রাহাত।রবির বড় বড় চোখ ছিল।চোখ দেখলে ঠিকই চিনত।শার্ট চিপছে লোকটা।রাহাত আস্তে আস্তে করে লোকটার পেছনে চলে গেল।এটা যদি কাকতালীয় হয় তবে?
রবি তোকে অনেক খুঁজেছে।তুই বলেছিলি আমাদের দেখা হবে।তোর ছেলের নাম রাহাত হবে।আর লুকোচুরি খেলিস না রবি।আর না।আল্লাহ।এটা যেন রবিই হয়!

কাঁপা কাঁপা পায়ে এগুচ্ছে রাহাত।লোকটার শার্ট নিংড়ানো শেষ।এখুনি পড়ে ফেলবে।রাহাত এখন লোকটার পেছনে।শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।এগিয়ে এলো লোকটার কাছে।হাত দিয়ে ধরলো লোকটার পিঠের কাটা দাগটা।চমকে পেছনে তাকালো রবি।

by Robin Ahsirt

No comments:

Post a Comment