Saturday 6 January 2018

আসুন জেনে নিই হালদায় বাস করা বিপন্ন প্রজাতির মিঠা পানির ডলফিন বা শুশুক সম্পর্কে

হালদা নদীতে আমরা যে শুশুকগুলো দেখতে পাই সেগুলো হচ্ছে এক ধরনের মিঠা পানির ডলফিন।

পৃথিবীতে আমাজন নদীতে থাকা ডলফিন ছাড়া আর সব মিঠা পানির ডলফিন (সাউথ ইন্ডিয়ান রিভার ডলফিন) ভারতীয় উপমহাদেশে বাস করে। উপমহাদেশে দুই প্রকার রিভার ডলফিন পাওয়া যায়। গাঙ্গেজ ডলফিন আর ইরাবতি ডলফিন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এদের দুই প্রকারকেই একটা স্পিসিস হিসাবে দেখা হত। পরে বিজ্ঞানীরা এ দুটো প্রজাতিকে আলাদা করেন। 


ইরাবতী ডলফিন পুরোপুরি মিঠাপানির ডলফিন না। এরা পাকিস্তানে ও ভারতের পশ্চিম অংশে সাগরে এবং সাগর নিকটবর্তি নদীতে (মুলত ব্রিড করতে) থাকে।

গাঙ্গেজ ডলফিন তথা শুশুক/শিশু/শিশুক (Platanista gangetica ) থাকে মুলত গঙ্গা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও কর্ণফুলি অববাহিকায় ঘোলা পানির নদীতে।

হালদার ডলফিনগুলো এই গাঙ্গেজ ডলফিন প্রজাতিরই। একে বিজ্ঞানীরা ব্লাইন্ড ডলফিনও বলে থাকে। জন্মান্ধ এই প্রানীটাকে বাংলাদেশ, ভারত এবং নেপালের কিছু নদী ছাড়া কোথাও দেখা যায় না।

এই গাঙ্গেজ ডলফিন বা শুশুকের মুখের চোয়াল সামনের দিকে বাড়ানো থাকে। উভয় চোয়ালের প্রতি পাশে দাঁতের সংখ্যা প্রায় ২৮-২৯ টি। । শুশুক ঘোলা পানিতে থাকে এবং এরা জন্মান্ধ। এরা মাছের মত পানিতে নিশ্বাস নেয়না, বাতাসে নিশ্বাস নেয়। এরা ডিম পাড়েনা বরং সন্তান জন্ম দেয় এবং বাচ্চাকে স্তনপান করায়।

এই শুশুকের বসবাস উপযোগী তাপমাত্রা হল ৮ - ৩৩ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। স্ত্রী শুশুক আকৃতিতে বড় (এভারেজে ২.৪-২.৬ মি) এবং পুরুষ শুশুক ছোট (এভারেজ ২-২.২ মি) লম্বা হয়ে থাকে। আর প্রস্থে গড়ে ৪৬ সেমি হয়। শুশুক সারাবছর ব্রিড করে এবং স্ত্রী শুশুক ১১ মাস গর্ভ ধারন করে।

বিজ্ঞানীদের মতে শিকার এবং পথ চলার জন্যে শুশুক একধরনের হাইপারসনিক শব্দ করে। সেই শব্দের প্রতিধ্বনি শুনে বাদুরের মত পদ্ধতিতে চলে। আরেকদল বিজ্ঞানীর ধারনা পানিতে কট কট জাতিয় শব্দ করে এরা পানির মধ্যেই একধরনের কম্পন করে। এক জোরা ফিন থাকে এবং এরা এক ধরনের গন্ধ জাতীয় তেল নিঃস্বরন করে মাছদের আকর্ষন করে এবং শিকার করে।

মাছ এবং অমেরুদণ্ডী জলজ প্রাণী এদের প্রধান খাদ্য। মাছের মধ্যে ক্যাট ফিশ, বেলে ও কার্পজাতীয় মাছ উল্লেখযোগ্য এবং অমেরুদণ্ডীদের মধ্যে উল্লেখ করার মত হচ্ছে চিংড়ী। শুশুক শিশুরা জন্মের ১-২ মাস পরেই কঠিন খাদ্য গ্রহণ করতে পারলেও এক বছর পর্যন্ত স্তন্যপান করে থাকে। এরা সর্বোচ্চ ২৬-২৮ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

IUCN, Bangladesh এর রেড লিস্টেড থ্রেটেন স্পিসিজের তালিকায় রয়েছে এই গাঙ্গেজ ডলফিন বা শুশুক এর নাম। http://www.iucnredlist.org/details/41758/0

১৯৯৪ সালে IUCN, Bangladesh কর্তৃক প্রথমবারের মত এই রিভার ডলফিন বা শুশুক Vulnerable অর্থাৎ আশংকাজনক বা সুরক্ষিত নয় হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়। ঠিক এর দুই বছর পর ১৯৯৬ সালে এটি বিপন্ন (Endangered) প্রজাতির তালিকায় স্থান পায়।

এই রিভার ডলফিন বা শুশুক মানুষের কোন প্রকার ক্ষতি করেনা। এরপরও অনেক জেলে এই শুশুক শিকার করে থাকে। মূলত শুশুকের ভেষজ গুণসম্পন্ন তেল ঔষধ তৈরি ছাড়াও মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হয়। এজন্য এর বাজারমূল্য অনেক। ফলে জেলেদের নজর শুশুকের দিকে পড়েছে।

এছাড়া রিভার ডলফিন বা শুশুকের আবাস ও প্রজননস্থল ধ্বংস বা মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে বিগত ৭০ এর দশকের পর থেকে আশঙ্কাজনক ভাবে এই প্রানীটার সংখ্যা কমে গেছে।

সম্প্রতি হালদা নদীতে অজ্ঞাত কারনে মারা যেতে শুরু করেছে এই বিরল প্রজাতির স্তনপায়ী জলজ প্রাণীটি।

বাংলাদেশের মিঠা পানির বিপন্ন এই স্তন্যপায়ী প্রানীটিকে বাঁচাতে এখনই সরকারীভাবে বড় পরিসরে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।


জিয়া চৌধুরী
সাংবাদিক।


তথ্যসুত্রঃ
১. www.iucnredlist.org
২. bn.bdfish.org
৩. উইকিপিডিয়া







No comments:

Post a Comment