Tuesday 2 July 2013

কৃষ্ণকলি- ছোট গল্প

 
মম বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষের ছাত্রী। চুপচাপ শান্ত ধরনের মেয়ে। বন্ধুবান্ধব তেমন একটা নেই।সেটা অবশ্য তার নিজের দোষেই। কারন সে সবার সাথে ঠিকমত কথাই বলতে পারে না। বিশেষত সুন্দরীদের সাথে। মমর গায়ের রং কালো। কিন্তু অসুন্দর নয়। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছে মেয়েরা পরিবারের বোঝা বিশেষত কালো মেয়েরা। ছোটদের মাথায় একটা কিছু ঢুকে গেলে তার খোলশ ভেঙে বেরিয়ে আসাটা বেষ কষ্টের। মমও বেরুতে পারে নি। তার দাদী সারাটাদিনই তার মাকে বলতেন,"অ বৌ।মাইয়া তো কাইল্যা পয়দা হইছে। বিয়া শাদী কেমনে দিবা? এই মাইয়ারে বিয়া দিতে তোমগো ফতুর অইতে অইব এই বইলা রাখলাম। "বাড়িতে তার অন্য ভাইবোন অনেক আদর পেত কিন্তু মমর গায়ের রং কালো ছিল বিধায় তার সে সৌভাগ্য হয় নি। অন্য ভাইবোনেরাও তার সাথে মিশত না। কালো গায়ের রং এর মেয়ে মম।যদি স্পর্শ লাগে ওরাও কালো হয়ে যাবে।প্রথম প্রথম বুঝত না মম।কিন্তু পরে যখন বুঝেছে তখন একাকিত্ব আর কালো হয়ে জন্মানোর হীনমন্যতা গ্রাস করে ফেলেছিল মমকে।সেই খোলশ ভেঙে আর বেরোতে পারে নি মম।


স্কুল জীবনে কিছু বান্ধবী থাকলেও আস্তে আস্তে মম সবার থেকে আলাদা হয়ে যায়।কারো সাথে মিশতে ভাল লাগত না।বান্ধবীর আম্মুরা মম কালো বলে মুখ টিপে হাসত।কেমন কেমন করে তাকাতো।দুনিয়ায় অনেক কালো মেয়ে আছে।শুধু ওকে দেখেই যে উনাদের এত হাসি পেত তা শত চিন্তা করেও বের করতে পারে নি মম।বরং সমাজ থেকে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে।নিজের অস্তিত্বকেই লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করত বারেবার।তাই তেমন কোন বন্ধু বান্ধবও হয় নি মমর।হোস্টেলে যাদের সাথে থাকে তারাই ওর খুব ভাল বান্ধবী।মমর অনুরোধেই মম সম্পর্কে ওরা কোন কথাও বলে না।এখনো মনে আছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বর্ষের যখন ফলাফল বের হল মম সেবার দ্বিতীয় হয়েছিল।আফসান বারী মম।কেউ চিনতে পারছে না।মমও চুপচাপ মজা দেখছে।হঠাত্‍ কে যেন বলল ঐ যে কালো করে একটা মেয়ে আছে না।ওই মেয়েটাই মম।রোল ৩২।এ কথা কানে যেতেই ৪৯ জোড়া চোখ একসাথে মমর দিকে তাকালো।মমর ইচ্ছে হচ্ছিল মাটি ফুঁড়ে ভেতরে চলে যেতে।


তবে মম খুব ভাল কবিতা লেখে।কৃষ্ণকলি নামটা খুব পছন্দ মমর।ঐ নামেই কবিতা লেখে মম।বিভিন্ন পত্রিকায়,কিছু সাহিত্য পত্রিকায় প্রায়ই ওর কবিতা ছাপা হয়।ওর কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক আছে ওদের ডিপার্টমেন্টে।তূর্য্য।লম্বা করে ছেলেটা।গায়ের রং ফর্সা।প্রায়ই পান্জাবী পড়ে।শীতের সময় গেরুয়া চাদর।চোখে লাল ফ্রেমের চশমা।খুব ভাল গান গায়।অসাধারন পর্যায়ের।তূর্য্যের গানের মস্ত ভক্ত মম।যখনি গান গায় চোখ বুজে শোনে মম।আর প্রতিদিনই মমর লেখা কবিতাগুলো আওড়ায় সে।কবিতাগুলোতে সুর দেয়।অন্য সবাইকে এনে পড়ায় কবিতাগুলো।দেখতে খুব ভাল লাগে মমর।অনেকবারই তূর্য্যকে বলতে শুনেছে,কৃষ্ণকলি ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না সে।কোথা থেকে নাকি শুনেছে ওর বয়স বেশী না হয়তো তূর্য্যের থেকেও কম।কবিতা পড়ে কবির প্রেমে পড়েছে সে।সত্যিকারের প্রেম।

মাঝেমধ্যে মম তূর্য্যের পাশে নিজেকে কল্পনা করে।
মম:পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতা,চোখ হরিনটানা বড় বড়,মেঘকালো দীঘল চুল,মুক্তোর মত দাঁত,হাসলে যে কেউই হাসির প্রেমে পড়বে।কিন্তু ওর প্রেমে হয়তো পড়বে না....গায়ের রং কালো....
এখানে এসেই থেমে যায় মম।কোথায় তূর্য্য!রাজপুত্রের মত।আর কোথায় মম!মানায় না।নিজের অজান্তেই বারবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে!

ওদিকে শুনেছে কৃষ্ণকলির পরিচয় পেতে উঠে পড়ে লেগেছে তূর্য্য।গানের কথা সুরের কথা বলে ভোলানোর চেষ্টা করছে সবাইকে।কিন্তু মম সাবধানী ভাষায় বলে এসেছে ওর পরিচয় পুরোপুরি গোপন রাখতে।

মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে মম।ওকে খুঁজতে খুঁজতে পথ হারিয়েছে তূর্য্য।এপথ যায়,ওপথ যায়।ফেরার পথ আর পায় না।আড়ালে চুপটি করে বসে থাকে মম।তূর্য্য ছুটে ছুটে খুঁজে বেড়ায় ওকে।কিন্তু পায় না।আড়াল থেকে মম বলে-"ওগো পথিক।তুমি কি পথ হারায়েছ?"তূর্য্য চমকে ফিরে তাকায়।কাউকেই পায় না।না পেয়ে কৃষ্ণকলির একটা কবিতা আবৃত্তি শুরু করে।কি সুন্দর কন্ঠস্বর!ঠিক যেন ডাকাতিয়া বাঁশির সুর।থাকতে না পেরে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে মম।মমকে দেখে চমকে ওঠে তূর্য্য।ফিরে চলে যায়।

প্রতিবারই একই স্বপ্ন।জেগে জেগেও একই স্বপ্ন।মমর কালো গায়ের রং দেখে ফিরে যায় পথিক।এ পর্যায়ে এসে কাঁদতে শুরু করে মম।একদিন ক্লাসেই কেঁদে দিয়েছিল।যথারীতি কেউ মমকে খেয়াল করে নি।করার কথাও না।পেছনের একটু কোনার সিটে বসে মম।সহজেই কারো চোখ পড়ে না ওখানে।শুধু দেখতে পায় তূর্য্য তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মমর দিকে।লজ্জা পায় মম।মাথা নিচু করে কবিতা লেখা শুরু করে।মাথায় চিন্তা একটাই,ওকে চিনতে পারেনি তো তূর্য্য।চিনলে ঐ রাতের স্বপ্নগুলোও হয়তো আর আসবে না।দাদী বলতেন কালো মেয়েদের নাকি ভাল জীবনসাথী জোটে না।ছেলেরা সাধ করে কখনো কালো মেয়ে বিয়ে করে না!কালো মেয়ে দেখলেই নাকি লম্বা সালাম দিয়ে চলে যায়।


কিছুদিন আগে কৃষ্ণকলির একটা ইন্টারভিউ ছাপা হয় পাঠকদের অনুরোধে।সেসব পাঠকের মধ্যে তূর্য্যও আছে।মম দর্শকদের সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে।বয়স,প্রতিষ্ঠান,প্রিয় গান,ছবি...শুধুমাত্র কয়েকটা জিনিস বাদে সব তথ্যই দিয়েছে মম।প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছে।ডিপার্টমেন্ট বা কোন বর্ষ সেসব কিছু বলে নি।শুধু বলেছে সে এখনো স্টুডেন্ট।বলেছিল সূক্ষ একটা আশা নিয়ে।তূর্য্য হয়তো খুঁজে বের করবে।অবশ্য এখন মনে হচ্ছে কাজটা ভুল করেছে।তূর্য্য নিশ্চয় কৃষ্ণকলি হিসেবে কোন সুন্দরীর ছবিই মন এঁকে রেখেছে।


বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিন।সবাই মিলে একটা পার্টি দিচ্ছে।বিদায় পার্টি।আর হয়তো দেখা হবে না।সবাই ব্যাস্ত হয়ে পড়বে।মমও এসেছে।ও সাধারনত এসব অনুষ্ঠানে আসে না।আজ এসেছে।বেশ ভালই লাগছে।হঠাত্‍ সবাই ওকে আপন করে নিয়েছে।সবাই একসাথে ছবি তুলছে।গান গাইছে।নাচছে।

রাত প্রায় দশটা বাজে।সবাই কলেজের হোস্টেলে থাকে তাই বাড়ি ফেরার তাড়া নেই কারোরই।আকাশের চাঁদটা আজ অনেক বড় আর সুন্দর।স্বপ্নীল চোখে জোত্‍স্না স্নান করছে আর তূর্য্যের কথা ভাবছে মম।শুনল তূর্য্য ঘোষনা করল ও নাকি একটা স্পেশাল গান করবে।তূর্য্যের গান ভালবাসে মম।তাই ফিরে তাকাল।মম দেখল তূর্য্য সোজা ওর চোখের দিকেই তাকিয়ে।ভয় পেলে মম।তূর্য্য গান ধরল-

কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম তারে
কালো!!
তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিন চোখ..

No comments:

Post a Comment